নবান্ন কবিতার সারাংশ



'নবান্ন'

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত






যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নবান্ন কবিতার বিষয়বস্তু:



নবান্নকে কেন্দ্র করে গরিব কৃষকের দুঃখ নির্ভর জীবন কাহিনী কবিতাটিতে ব্যক্ত হয়েছে। গরিব কৃষকের বাড়িতে বন্ধু এসেছে শুভ নবান্নের দিনে। যে কোনো কৃষকের বাড়িতে অঘ্রাণ মাসে নবান্ন দিন হয়ে ওঠে উৎসব মুখর। মাঠের কাজ বন্ধ থাকে, পাড়ায় পাড়ায় চাষিরা উৎসবে মেতে ওঠে। ঘরের আঙ্গিনায় লেপা মোছা করে আলপনা আঁকা হয়। মরাইয়ের পাশে আলপনা এঁকে যেন লক্ষ্মী দেবীকে আহ্বান করা হয়। এমন দিনের আগেই তার মাঠ ভরা পাকা ধান দুর্বিপাকে নষ্ট হয়ে গেছে। নবান্নের দিনে তার বাড়িতে একমুঠো চালও নেই। আগত বন্ধুর কাছে চাল না থাকার পিছনে চাষী জীবনের যে করুণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে কবি তাই চাষীর মুখ দিয়ে বলতে থাকেন।

দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে সেই দুঃখের কাহিনী চাষী বলতে থাকে। তার ছোটখাটো একটা ভূঁই ছিল তাতে সে যথাসাধ্য ধানও বপন করেছিল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় শ্রাবণ ও আশ্বিন মাস নানা আশা ও আতঙ্কে কোথা দিয়ে যে কৃষকের দিনগুলি কেটে গেছে সে নিজেই তা খেয়াল করতে পারিনি। বন্যা দুর্যোগ যখন এসেছিল তখন সে বালির বাঁধ দিয়ে বন্যাধারাকে প্রতিরোধ করেছে। বুকের রক্ত জল করে সে দুর্বল চারাগাছ গুলিকে সেচন করে সজীব ও সতেজ করে তুলেছিল। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সে দেখল তার মাঠ শস্য-শ্যামলা ভরে উঠেছে। আশা ও আনন্দে তার বুক ভরে উঠেছে। পাঁচরঙা ধানে তার মাঠ এমনভাবে সজ্জিত যা দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়।

তারপর এল অঘ্রাণ। এই মাসেই যার যেমন ধান পাকে তেমনি ধাপে ধাপে পাকা ধান কেটে চাষিরা খামারে, গোলায় তোলে। কিন্তু সে প্রতিদিন ভাবে ফসল কাটার ঠিক সময় হয়নি আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে চায়। কেননা সে জানে অঘ্রাণ মাসে দৈব দুর্বিপাক তেমন ঘটে না তাই সেই সুযোগে সে তার মরাই সারানোর কাজ শেষ করে সবে ধান তোলার জন্য খামার গোছাতে হাত দিয়েছে ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ দৈর্ঘ্য দুর্বিপাকে তার পাকা ধানে দুর্যোগের মরাই পড়ে যায়। ক্ষেত ভরা পাকা ধান জমিতেই রয়ে গেল। বন্ধুর হয়তো এই ধানের গল্প শোনার ধৈর্য ছিল না, তাই তার হাই ওঠে। গরিব চাষি তাই বন্ধুর এই অবজ্ঞার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার ব্যক্তিগত দুঃখময় ধানের গল্প বন্ধ করে দেয় এবং অকারণে এই বাচালতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

কবিতাটির মধ্যে কবি বন্ধুকে এক প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। সে যেন প্রকৃতি-তন্ময়ী রোমান্টিক মানুষ। তার কি কখনো চির দারিদ্র-লাঞ্ছিত কৃষক জীবনের গল্প শুনতে ভালো লাগে! বরং দিগন্তবিস্তৃত বাংলা রূপ-রস-সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ তা দেখতে চায়, তার কথা শুনতে চায়। তাই চাষী ফিরে যায় সেই অতীতের অভ্যস্ত দৃশ্য দেখতে।
চাষী বন্ধুকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে যেন সে বাংলার বিস্তৃত মাঠের বুকে গিয়ে সেই প্রভাত আলোকে দূরে দূরে চেয়ে থাকে। সেখানে সে গভীর আসক্তিতে দেখতে পাবে বাঁকা নদীর এঁকেবেঁকে চলার চঞ্চল লাবণ্য, চরের বুকে এযেন জরির ডুরে জড়িয়ে থাকার এক প্রেম-মাধুর্য, আর নীল আকাশের বুকে মুক্ত মরালের ছন্দময় সুরমূর্ছনা, শীতের সকালে দিক বালাদের এলায়িত আঁচল ও বেণী। এ যেন মুহূর্তের মধ্যে রোমান্টিক আবেশে বন্ধুকে বিরক্তির পরিবেশ থেকে মুক্তি দেওয়া, এ যেন কঠিন বাস্তবের দুঃখ নির্ভর জীবন পরিবেশ থেকে মুহূর্তে অধরা রোমান্টিক চেতনালোকে পৌঁছে দেওয়া। কেননা বন্ধুত্বটি তো প্রথাসিদ্ধ রোমান্টিক দৃষ্টিতে অভ্যস্ত ও আসক্ত।

কবি অবশ্য আবার চাষিকে কেন্দ্র করে বাস্তবের জীবন পরিবেশে পাঠককে ফিরিয়ে এনেছেন। অঘ্রান মাস, নবান্নের মাস। অন্নহীন, বস্ত্রহীন দরিদ্র কৃষক এই বাংলার স্নিগ্ধ জলবায়ু ও নরম মাটিতে লালিত। তার বিস্তৃত হৃদয় দিয়ে বন্ধুকে আপ্যায়িত করতে চায়। লোকোত্তর নয় লোকায়ত জীবনই এখানে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। তাই গরিব চাষি বন্ধুকে অনুরোধ করে নবান্নের দিনে অন্ন গ্রহণ না করে সে যেন না যায়। বারবেলা টা কেটে গেলে সে তার বিপর্যস্ত খেতে যাবে ঘেঁটেঘুঁটে কিছু ধানের দানা সংগ্রহ করে আনবে। আর সেই অন্নপিণ্ড দুজনে ভাগ করে খাবে। বেদনা মিশ্রিত চূড়ান্ত রূপ ফুটে উঠেছে কবিতাটির শেষ দুটি লাইনে। ভক্ষণের পরে বিদায় ক্ষণে বন্ধুকে মাথার দিব্যি দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে চেয়েছে বিষধর সাপ যেমন করে দংশন করে বিষ ঢেলে দেয় সমস্ত শরীরে তেমনি সে যেন ফণা সদৃশ দুহাত তুলে বিষসদৃশ আশিষ ঢেলে দেয় তার মাথায়। হয়তো কবি বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন গরিব চাষি বন্ধুটি যথাযোগ্য আপ্যায়ণ করতে না পারার জন্য এবং অকারণ তার ব্যক্তিগত দুঃখ কাহিনী শোনার জন্য রোমান্টিক পরিপাটি বন্ধুটির ঘৃণা-বিদ্বেষ অভিশাপই তার প্রাপ্য।


Comments