মেঘনাদবধ কাব্যের রসবিচার

 







মেঘনাদবধ কাব্যের রসবিচার :

ভারতীয় আলংকারিকেরা কাব্যের আত্মা কি, তা অন্বেষণ করতে গিয়ে সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। এই অভিমতটি সর্বস্তরের আলংকারিকেরা মেনে নিয়েছেন। প্রতিটি রচনা রসের বিচারে কাব্য বা সাহিত্য হয়ে ওঠে। মেঘনাদবধ কাব্যকে রসের বিচারে সাহিত্যিক মহাকাব্যরূপে সমালোচকরা স্বীকার করে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হল এই কাব্যে স্থায়ী রসের মধ্যে কোনটি প্রধান হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নে সমালোচকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রয়েছে। কেউ বীর রসের উপর জোর দিয়েছেন, কেউ করুন রসের কথা বলেছেন, আবার কেউ উভয় রসের খোঁজ পেয়েছেন এই কাব্যে। মাইকেল মধুসূদনের জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু মেঘনাদবধ কাব্যের স্থায়ী রস সম্পর্কে লিখেছেন- "অনেকে মেঘনাদবধ কাব্যকে বীররস প্রবল কাব্য বলিয়াই অবগত আছেন; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মেঘনাদবধেবীররা স অপেক্ষা করুণরসেরই প্রাধান্য। বর্ণনীয় বিষয় পাঠান্তে পাঠকের হৃদয়ের যেভাবে স্থায়ী নয় সেই ভাবের বিচারে মেঘনাদবধকে করুণরস প্রধান কাব্য বলিয়া নির্দেশ করাই সঙ্গত।"


সমালোচক তারাপদ মুখোপাধ্যায় 'মেঘনাদবধ কাব্য' এর রসের প্রশ্নে বীররসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি 'আধুনিক বাংলা কাব্য' গ্রন্থে লিখেছেন- "কেহ কেহ মেঘনাদবধ কাব্যকে করুণ-রস প্রধান বলিয়া মনে করিয়াছেন, কিন্তু প্রকৃত বিচারে এ কাব্যে বীররস ও করুণরস পরস্পরের পরিপোষক ও পরিপূরক। একটি বাদ দিয়া আরেকটির সার্থকতা নাই। কবি করুণরসের কাব্য লিখিয়াছেন সেটা ভুল ধারণা। এ কাব্যে করুণ রস থাকলেও সে করুণরস বীররসকে পুষ্ট করিয়াছে এবং সেই বীর রস প্রধানত শক্তিশালী রাবণ চরিত্র হইতে উৎসারিত হইয়াছে।"

'মেঘনাদবধ' কাব্যের রচয়িতা মধুসূদন তার এ কাব্যে কোন রসের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তা আলোচনা করলে দেখা যায় কবির মনের মধ্যেই একটা দ্বিধা ছিল। কবি তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন - "I am going to celebrate the death of my favourite indrajit. do not be frightened my dear fellow. I don't trouble my readers with Vira ras." বীর রসের কাব্য হয়ে উঠুক তাঁর 'মেঘনাদবধ' এ বাসনা মধুসূদন এর কতটা ছিল তা অনেকখানি বোঝা যায় আলোচ্য পত্রাংশ থেকে।

'মেঘনাদবধ' কাব্যের বীররস এবং করুণরস যেভাবে সমগ্র কাব্যজুড়ে ছড়িয়ে আছে তাতেই বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। যদি বিষয়গুলিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেখা যায় তবে ভালো হয়।য়রাবণ চরিত্রের মধ্যে যখন লঙ্কেশ্র সত্তার প্রকাশ ঘটেছে তখন বীর রসাত্মক কণ্ঠস্বর শোনা গেছে এবং তার ক্রিয়া-কলাপের মধ্যে বীরোচিত দীপ্তি ফুটে উঠেছে। বীর বাহুর মৃতদেহ যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকতে দেখে প্রাসাদ শিখর থেকে রাবণ বীরের প্রশস্তি গেয়ে বীর রসের বাণী উচ্চারণ করেছেন-

"যে শয্যায় আছি তুমি শুয়েছ, কুমার

প্রিয়তম, বীরকূল সাধ এ শয়নে

সদা, রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,

জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?

যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক তারে!"

লঙ্কেশ্বর রাবণের এই সংলাপ নিশ্চিত বির রসে সিক্ত।আবার যখন রাবণকে আমরা নিহত পুত্রের পিতা রূপে দেখি তখন তার সংলাপে এবং ক্রিয়াকলাপে করুণরসের মন্দাকিনী বইতে থাকে। বীর বাহুর মৃত্যুর শোকে পিতার রাবণের 'ঝর ঝর ঝরে অশ্রুধারা' চোখের জলে রাবণ যে কথা বলেন তা করুন রসে সিক্ত। সারণ যখন বিধাতার প্রসঙ্গ টেনে বারণকে সান্তনা দেন তখন পিতা রাবণ বলে ওঠেন- 

"কিন্তু জেনেশুনে তবু কাঁদে এ পরান

অবোধ, হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম

তাহারে ছিঁড়িয়া কাল, বিকল হৃদয়

ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে

যবে কুবলয় ধন লয় কেহ, হরি।"

পিতৃহৃদয়ের চিরন্তন বেদনা কাতরতা ফুটে উঠেছে আলোচ্য অংশে, যা করুণরসের আধার।

চিত্রঙ্গদার সঙ্গে রাবণ যখন লঙ্কেশ্বর হয়ে কথা বলেছেন তখন সেখানে বী রসের প্রকাশ ঘটেছে ।বীরবাহুর মৃত্যুকে বীর সন্তানের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করে রাবণ চিত্রাঙ্গদাকে বলেছেন-

"দেশবৈরী নাশি রণে পুত্রবর তব

গেছে চলি স্বর্গপুরে; বীর মাতা তুমি

বীরকর্মে হত পুত্র হেতু কি উচিত

ক্রন্দন?

চিত্রাঙ্গদাকে বীরের মাতা বলে সম্মানিত করে লঙ্কেশ্বর বীররসের সঞ্চার ঘটিয়েছেন। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসায় ভরা এ উক্তি, স্বাধীনতা রক্ষা করার পরম কর্তব্যবোধ ভরা এই উক্তি বীররসের ধারক ও বাহক।

মেঘনাদ প্রমীলার কাহিনীও বীর রসের আকর। মেঘনাদ মহাকাব্যের নায়কের মতোই শৌর্য বীর্যে উজ্জ্বল। ও মেঘনাদ পত্নী প্রমিলাও তার যোগ্য সহচরী রূপে এই কাব্যে আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছেন। প্রথম স্বর্গে বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্র -

"ছিঁড়িয়া কুসুমদাম রোষে মহাবলী

মেঘনাদ ফেলাইয়া কনক বলয়

দূরে ;....."

বীরোচিত প্রতিক্রিয়ায় অস্থির হয়ে উঠে নিজেকে ধিক্কার জানিয়েছেন মেঘনাদ এবং প্রমীলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লঙ্কায় এসে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সর্গে ইন্দ্রজিতের উন্নত মানব ধর্মের প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে ষষ্ঠ স্বর্গের তার বিরোচিত উক্তিতে বীর রসের উৎসাহ ব্যঞ্জন ভাব ফুটে উঠেছে। তৃতীয় স্বর্গে প্রমিলা প্রমদ উদ্যান থেকে রাতের বাধা অতিক্রম করে যখন স্বামী মেঘনাদের উদ্দেশ্যে একশত সখীসহ যোদ্ধৃবেশে ধাবিত হয়েছেন তখন বীর রসের সঙ্গে চমৎকারের বিস্ময় মিশে অদ্ভুত উন্মাদনা সৃষ্টি করে-

"আমি কি ডরাই, সখি ভিখারি রাঘবে"

কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি"

প্রমিলার এই ধরনের উক্তি বীর পত্নীর বীরত্বকে ব্যক্ত করেছে- যা বীর রসকে চারুত্বদান করেছে। অষ্টম স্বর্গে প্রমিলা স্বামী মেঘনাদের চিতায় যেভাবে আত্মদান করেছে তা সতীদাহ প্রথা হয়ে ওঠেনি, হয়ে উঠেছে স্বামী প্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন। স্বেচ্ছায় বীর স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় আরোহন ঘটনা প্রেমের সাহসী প্রকাশ ঘটেছে, যা করুণ রস নয় বীর রসকে উদ্দীপ্ত করেছে।

বীরবাহু মাতা চিত্রাঙ্গদার মধ্যে দিয়ে বীর রস এবং পুত্রের মঙ্গলকামনায় শঙ্কাকুল মন্দোদরীর মধ্যে দিয়ে করুন রসের প্রবাহ ঢেউ খেলে উঠেছে।

সীতা সরমার কাহিনী নিয়ে চতুর্থ সৃষ্টি, তাতে চোখের জল ঝরছে কিন্তু তা করুণ রসের কাহিনী হয়ে ওঠেনি। অতীতের সুখ স্মৃতি ও বর্তমানে সরমার সান্নিধ্য সেটাকে চরম দুঃখের হাত থেকে দূরে রেখেছে।রাম লক্ষণ বিভীষণের কাহিনী দেবানুগ্রহে গতিশীল হলেও রামচন্দ্রের আচরণে ও সংলাপে বীরের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। ভাই লক্ষণের জন্য রামের যে দুশ্চিন্তা এবং লক্ষণের শক্তিশেলে পতিত হওয়ার রামের মধ্যে করুণ রস করেছে। রাম যখন লক্ষণ অগ্রজ তখন তাঁর কন্ঠে করুন রসাত্মক সংলাপ উচ্চারিত হয়েছ। এই কাব্যে রামচন্দ্রকে বীররসাত্ত্বক গৌরবের জায়গায় দেখা যায়নি। নবম সর্গে মেঘনাদ বধের কাহিনী সমাপ্তি ঘোষিত হয়। এই সর্গের রাবণের পুত্র বিয়োগে ব্যথার শোক ফুটে উঠেছে। মেঘনাদকে ঘিরে যে আশালতার জন্ম ও বৃদ্ধি হয়েছিল তা পূর্ণ না হওয়ার রাবণের শোক বৃদ্ধি পায়। পুত্র মেঘনাদের সৎকারের ব্যবস্থা বিষন্ন চিত্তে রাবন করেছেন। কাব্যের সমাপ্তিটি দেখা গিয়েছে ব্যর্থ প্রাণীর হাহাকার বিষন্নতায় শেষ হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্য ইন্দ্রজিতের মৃতদেহ সিন্ধু পারে যথাযোগ্য মর্যাদায় সৎকার করার পর রাবণ সহ অন্যান্য সকলে শোক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরে এসেছে -

"করি স্নান সিন্ধু নীরে রক্ষোদল এবে

ফিরিলা লঙ্কার পানে, আর্দ্র অশ্রুনীরে

বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে।

সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।"

বিপদের বেহালায় যে বিসর্জনের সুরে 'মেঘনাদবধ' কাব্যের সমাপ্তি ঘোষিত হল তাতে এই কাব্যকে করুন রসে কাব্য বলা বাঞ্ছনীয়। সাহিত্যিক মহাকাব্য রূপে 'মেঘনাদবধ' কাব্যের নায়ক রাবণ এবং এই কাব্যের প্রধান রস করুণরস। অন্যদিকে মেঘনাদের বীরত্ব ও নায়কচিত শৌর্য বীর্য বীররসের বার্তা বহন করে এসেছে। প্রমিলা সেই বীর রসের রূপকে আপন সৌন্দর্যে ও সাহসিকতায় মাধুর্যন্ডিত করে তুলেছেন। বীর রসের পুষ্টি সাধনে শৃঙ্গাররস সঞ্চারীর কাজ করেছে।

এ আলোচনার সার কথা হলো 'মেঘনাদবধ' কাব্য কবি মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এ কাব্যে করুন রস ও বীররস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, সৃষ্টি করেছে এক স্বতন্ত্র কাব্যরসের ধারা যা বীরও নয় আবার করুণও নয়, যা উভয় রসের সমবায়ে সৃষ্ট এক স্বতন্ত্র সুর। তা হল Sublime. কখনো কখনো করুণ রস বীররসকে পরিপুষ্ট করেছে, কখনো বীররসের কারণে করুণ রস ঘনীভূত হয়েছে। সুতরাং রসের বিচারে 'মেঘনাদবধ' যথার্থ সাহিত্যিক মহাকাব্য হয়ে উঠেছে।।


আলোচনায়: সীমা মিস 





Comments