বিদ্যাপতির "মাধব বহুত মিনতি করি তোয়" পদটির কাব্যসৌন্দর্য আলোচনা করো।

বিদ্যাপতির "মাধব বহুত মিনতি করি তোয়" পদটির কাব্যসৌন্দর্য আলোচনা করো।


মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।

দেই তুলসী তিল এ দেহ সমৰ্পিলঁ

দয়া জনু ছোড়বি মোয় ৷৷

গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি

যব তুহুঁ করবি বিচার।

তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি

জগ বাহির নহ মুঞি ছার।

কিয়ে মানুষ পশু পাখী কিয়ে জনমিয়ে

অথবা কীট পতঙ্গ।

করম-বিপাকে গতাগতি পুন পুন'

মতি" রহু তুয়া পরসঙ্গ ।।

ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর

তরইতে ইহ ভবসিন্ধু।

তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন 

তিল এক দেহ দীনবন্ধু।।


আলোচনা : প্রার্থনার এই পদটি যেন মৈথিলি ভাষায় রচিত মাধব-স্তোত্র। জীবনের অস্তিম লগ্নে এসে কবি আর ঐশ্বর্য-সম্পদ চাননি। তিল-তুলসী দিয়ে নিজের দেহকে মাধবের কাছে সমর্পণ করেছেন! দোষ-গুণ বিচার করতে বসলে, তাঁর মধ্যে গুণের লেশ মাত্রও পাওয়া যাবে না।


একথা কবি সবিনয়ে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তবুও তিনি জানেন, জগন্নাথ তাকে গ্রহণ করবেন। কারণ কবি নিজে তো ঈশ্বরের জগতেরই অন্তর্ভুক্ত। কবি বলছেন, কর্মবিপাকে তাঁকে বারবার পৃথিবীতে যাতায়াত করতে হবে, হয়তো কখনো তিনি মানুষ হবেন, আবার কখনো পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ হয়েও জন্মাতে পারেন। কর্মদোষে এই ভাবে বারবার তাঁকে আসতে যেতে হবে, কিন্তু তাঁর মন যেন মাধবের সঙ্গেই থাকে। এই বিপুল ভবসিন্ধু পার হওয়ার জন্যে বিদ্যাপতি তাই অত্যন্ত কাতর চিত্তে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন, তাঁর পদপল্লবের এক তিলও যেন তিনি লাভ করেন।


প্রার্থনার অন্যান্য পদে জীর্ণ বার্ধক্যের প্রতি, যৌবনের অদম্য ভোগস্পৃহার প্রতি যে তীব্র ঘৃণা, এই পদে তা অনুপস্থিত। আত্মনিবেদনে নম্র এই পদটি যেন মাধবের চরণেই সমর্পিত। কবি এখানে শাস্ত ভক্তিরসের পূজারী। তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের পূর্ববর্তী, তাই মাধব তাঁর কাছে পরম ঐশ্বর্যময় জগন্নাথ। জয়দেবের কাব্যেও আমরা “দিনমণি মণ্ডল মণ্ডন ভবভয় তঞ্জন” কৃষ্ণের বন্দনা পাই। কিন্তু সেখানে ব্যক্তি জয়দেবের নয়, সমষ্টির জন্যে কবির ভক্তিময় প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে রাধার শরণাগতির আর্ত হাহাকার থাকলেও কবির ভক্তিপ্রাণতার কোনো ইঙ্গিতই নেই। অন্যদিকে বিদ্যাপতির এই প্রার্থনা পদে জীবনের অন্তিম প্রান্তে অবসন্ন পরমায়ুর প্রহরে ব্যথারক্তিম গোধূলি আলোর করুণ বিষণ্ণতা। তাঁর রাধা দেহকে পূজাবেদী করে মাধবের অর্চনা করেন, তার বেদনার অশ্রুসরোবরে ফুটে থাকে তপস্যার অমেয় লাবণ্য। ঠিক তেমনি করে এই কবিও তাঁর সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও পাপ- পুণ্য নিয়ে শরণাগত দীন ও আর্তচিত্ত নিয়ে পরিত্রাণপরায়ণ মাধবের চরণে আপন সত্তাকে পূজাপুষ্পের মতো অঞ্জলি দিয়েছেন। রাজ্যসভার ভোগখিন্নতা, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার উত্থান- পতনের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তাঁর পূর্বপুরুষের ত্যাগনম্র জীবনাগ্রহের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার— এইসব কিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে বিদ্যাপতির এই কবিসত্তা।


Teacher: Sima Ghosh ( Bengali honours, M.A, B.ED)

Comments