ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান।


ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান।

ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্যের কবি। তাঁর বিখ্যাত কাব্য 'অন্নদামঙ্গল'। তাতে তিনি অন্নদার মাহাত্ম্য ও পূজা প্রচার এবং তাঁর ভক্তদের নানা কাহিনী বর্ণনা করেছেন। হর গৌরীর পৌরাণিক কথাকে তিনি নিজের মতো উপস্থাপন করে তাঁর আশ্রয়দাতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মনোরঞ্জন করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমরা আশ্চর্যভাবে লক্ষ করি, তাঁর এই কাব্যে কোথাও কোথাও ইতিহাসের কাহিনী মিশে আছে। তাঁর কাব্যের 'গ্রন্থসূচনা' ও 'কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন' অংশে এই ইতিহাসের অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যের কবিরা সাধারণত ইতিহাসের কথা বলেন না। গল্প রস পরিবেশনে তারা মত্ত থাকেন। সেখানে ভারতচন্দ্রের কাব্যে ইতিহাসের তথ্য দেখে আমরা একটু আশ্চর্য হই, একটু বিস্মিতও হই।

১। আসলে ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি, রাজনৈতিক উত্থান পতনের সঙ্গে তাঁর জীবন জড়িত ছিল। একটি বৃহৎ রাজসভায় তিনি বসবাস করেছিলেন। তখনকার মুঘল শাসনের শেষ পর্যায়টুকু তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তাই তিনি নিজেও ছিলেন ইতিহাসের একজন পূর্ণসাক্ষী। আর এভাবেই তাঁর মনে ইতিহাস-চেতনা দানা বেঁধেছিল।

২। দ্বিতীয়ত, ভারতচন্দ্র তাঁর আশ্রয়দাতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথা বলতে তার পূর্বাভাস রূপে ইতিহাস কথা এনেছেন। অন্য কথায়, অন্নদার আশীর্বাদপুষ্ট রাজাকে যে বাইরের শত্রুরা কিছুই করতে পারবে না, এই ভাবনাটিই প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের তথ্য এনেছেন। তাতে দুটি জিনিস প্রকাশিত হয়েছে—

ক) কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ের দেশ জোড়া রাজনৈতিক বিপর্যয়। খ) কৃষ্ণচন্দ্রের সভার সবিস্তার পরিচয়।

'গ্রন্থ সূচনা' অংশে ইতিহাসের তথ্য :

ভারতচন্দ্রের সময়টা ছিল মুঘল শাসনের শেষ পর্যায়। তখন রাজতন্ত্রের ইতিহাস হত্যা প্রতিহত্যা ষড়যন্ত্র প্রতারণা এবং খুনোখুনিতে ভরপুর। বিলাস ব্যসন-অত্যাচার- লুঠতরাজ যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় তখন দেশ জর্জরিত। ভারতচন্দ্র সেই ঘুনরজিত ইতিহাসের কাহিনীকে 'গ্রন্থসূচনা' অংশে লিপিবদ্ধ করেছেন। তখন নবাব ছিলেন সুজাখার পুত্র সরফরাজ খাঁ। তাঁর একজন শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন আমল চন্দ্র রায়। তখন পাটনার নবাব ছিলেন আলিবর্দী খাঁ (মহাবদজঙ্গ)। তিনি বাংলায় এসে যুদ্ধ করে সরফরাজকে হত্যা করলেন। ওদিকে কটকে নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলী খাঁ আলিবর্দী তাকেও বিতাড়িত করলেন এবং সেখানে ভাইপো সৌলদজঙ্গকে বসালেন। সৌলদজঙ্গ নবাব হলে মুরাদবাখর তাকে ফাটকে ফেললেন। এবং দেশে অত্যাচার আরম্ভ করলেন। মহাবদজঙ্গও তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে ভাইপো সৌলদজঙ্গকে ছাড়িয়ে আনলেন এবং উড়িষ্যায় লুঠতরাজ আরম্ভ করলেন। ভারতচন্দ্র লিখেছেন :

সুজা খাঁ নবাবসুত সফররাজ খাঁ। ছিল আলিবর্দী খাঁ নবাব পাটনায়। তদবধি আলিবর্দী হইলা নবাব। কটকে মুর্শিদকুলী খাঁ নবাব ছিল। কটকে হইল আলিবর্দীর আমল। নবাব সৌলদজঙ্গ রহিলা কটকে।

দেওয়ান আমলচন্দ্র রায় রায়রারী।। আসিয়া করিয়া যুদ্ধ বধিলেক তায়।। মহাবদজঙ্গ দিলা পাতশা খেতাব।। তারে গিয়া আলিবর্দী খেদাইয়া দিল।। ভাইপো সৌলদজঙ্গ দিলেন দখল।। মুরাদবাখর তারে ফেলিল ফাটকে।।

তারপর চললো অত্যাচার :

লুঠি নিল নারী গারী দিল বেড়ি তোক।

শুনি মহাবদজঙ্গ চলে পেয়ে শোক।।

উত্তরিল কটকে হয়ে ত্বরাপর।

যুদ্ধে হারি পলাইল মুরাদবাখর।।

ভাইপো সৌলদজঙ্গকে খালাস করিয়া। 

উড়িষ্যা করিল ছার পুঠিয়া পুড়িয়া।।


তারপর মহাবদজঙ্গ (আলিবর্দী) বিস্তর লোক লস্কর নিয়ে ভুবনেশ্বরে এলেন। এইভাবে ভারতচন্দ্র খুনোখুনির একটি সত্যিকার ইতিহাস খাঁটি ঐতিহাসিকের মতোই বর্ণনা করেছেন।


(খ) এই প্রসঙ্গে কবি 'বর্গীর হাঙ্গামা' বর্ণনা করেছেন :

বর্গী মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।

আইল বিস্তর সৈন্য বিকৃত আকৃতি।।

লুঠি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল। 

গঙ্গা পার হৈল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।

কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি। লুঠিয়া লইল ধন কিউড়ী বহুতী।। বর্গীর হাঙ্গামায় কী ভাবে গ্রাম বিধ্বস্ত হয়েছিল - এই বর্ণনা তার বাস্তব ও ঐতিহাসিক চিত্র।

এরপর মহাবদজঙ্গ শুদ্ধ শান্তমতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। যুদ্ধে কৃষ্ণচন্দ্র হারলেন। নবাব তাঁর কাছে ১২ লক্ষ টাকা দাবী করলেন। টাকা না দিতে পারার জন্য আলিবর্দী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করলেন -

মহাবদজঙ্গ তারে ধরে লয়ে যায়।

নজরানা বলে বার লক্ষ টাকা চায়।।

বন্ধ করি রাখিলেন মুর্শিদাবাদে।

কত শত্রু কত মতে লাগিল বিবাদে ।।

কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন' অংশে ঐতিহাসিক চিত্র দুই

'কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন' অংশে গুণমুগ্ধ কবি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে পাই –

(ক) প্রথমেই কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবার বর্ণনা – কৃষ্ণচন্দ্রের দুই পত্নী। প্রথম পত্নীর পাঁচজন পুত্র। তাঁরা হলেন— শিবচন্দ্র, ভৈরবচন্দ্র; মহেশচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র। এই পক্ষের জামাই ফুলিয়ার জয়গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্রই যুবরাজ। আর এক পুত্র শম্ভুচন্দ্র। এই পক্ষের জামাতারা হলেন - রামগোপাল, নন্দগোপাল। এই প্রসঙ্গে কবি রাজার দুই ভগ্নীপতি, ভাগিনা, ভাগ্নিজামাই এবং রাজার পিসা, পিসার তিন জামাই ইত্যাদি বহু লোকের নাম উল্লেখ করেছেন।

(খ) তারপর কবি রাজসভাসদ বর্ণনা করেছেন। সভাসদদের মধ্যে আছেন কালিদাস সিদ্ধান্ত, কন্দর্ণ সিদ্ধান্ত প্রমুখ। এছাড়া আছেন গণক, বৈদ্য ও নানা পারিষদ।

(গ) তার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন আমোদ প্রমোদের কর্তা ব্যক্তিদের যেমন- কালোয়াত গায়ন বিশ্রাম খাঁ প্রভৃতি। মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি।। নর্থকপ্রধান শেরমামুদ সভায়। মোহন ঘোষালচন্দ্র বিদ্যাধর প্রায়।।

(ঘ) এরপর কবি বিভিন্ন শিরোপাধারী সৈন্য সামন্তদের কথা বলেছেন। বলেছেন আমিন,

পেশকার, দেওয়ান, অশ্বরক্ষক, হস্তীরক্ষক প্রভৃতির প্রসঙ্গ।

(ঙ) তারপর বলেছেন রাজ্যের সীমানার কথা। (চ) সর্বশেষে রাজসভার ঐশ্বর্য, আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসব্যসনের নানা চিত্র এনেছেন।

ইতিহাসের সঙ্গে কবিকল্পনার মিশ্রণ :

'ইতিহাসের তথ্য' বলতে এই অংশগুলিকেই বুঝি। কিন্তু একটি কথা এ প্রসঙ্গে উচ্চারণ

করতে হয়—কবি এই ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে তার কল্পনাকে মিশিয়ে দিয়েছেন। তার প্রমাণ সরফরাজ, আলিবর্দী, মুর্শিদকুলী, মুরাদবাখর প্রমুখের যে খুনোখুনি ও যুদ্ধ তার শেষ দিকে আছে মহাবদজঙ্গ ভুবনেশ্বরে আসতেই কবি শিব দুর্গা ও নন্দীর কথা টেনে আনলেন এবং বর্গীর রাজাকে স্বপ্ন দিলেন—এখানে ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনা মিশে গেল। তারপর মহাবদজঙ্গ কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করলেন। পরক্ষণেই কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর স্তব আরম্ভ করলেন। দেবী তাঁকে স্বপ্ন দিলেন। এখানেও ইতিহাস মিশে গেল কল্পনার সঙ্গে।

ভারতচন্দ্র আসলে মধ্যযুগের কবি। গল্প বলতেই তিনি উদ্‌গ্রীব আর তারই ফাঁকে ফাঁকে দু একবার ইতিহাসের তথ্য এনেছেন। তাতে তাঁর কাব্য অধিক মর্যাদা লাভ করেছে। শ্রোতা পাঠক ভক্তরাও এক শ্রেণীর নতুন রস আস্বাদ করতে সুযোগ পেয়েছেন। ফলে 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে ইতিহাসকথা যথার্থ ইতিহাস সম্মত না হলেও তা যে ইতিহাস ভাবনার একটি অভিনব স্বাক্ষর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


Teacher: Sima Ghosh (Bengali honours, M.A, B.ed)


Comments