লঙ্কাকাণ্ড অবলম্বনে বিভীষণের চরিত্র আলোচনা করো।

  লঙ্কাকাণ্ড অবলম্বনে বিভীষণের চরিত্র আলোচনা করো।


কৃত্তিবাস চরিত্র সৃষ্টিতে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।তিনি অতি যত্নে বিভীষণ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। 


জন্মবৃত্তান্ত:


পৌরাণিক কাহিনি মতে বিশ্রবার ঔরসে নিকষা বা কৈকসী গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। বিভীষণের অপর দুই ভাইয়ের নাম রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, স্ত্রীর নাম সরমা। দুটি সন্তান–পুত্র তরণীসেন ও কন্যা কলা। সুমালী কুবেরের মতো দৌহিত্র লাভের আশায় তাঁর কন্যা কৈকসীকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠান। ধ্যানস্থ অবস্থায় বিশ্রবা, তাঁর কাছে কৈকসীর আসার কারণ অবগত হয়ে কৈকসীর সঙ্গে যৌনমিলন করেন। তবে ইনি ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, অসময়ে যৌনসম্ভোগ করার কারণে কৈকসী রাক্ষসের জন্ম দেবেন। এরপর কৈকসী উত্তম পুত্র প্রদানের বিশ্রবাকে অনুরোধ করলে, বিশ্রবা সন্তুষ্ট হয়ে বলেন যে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ধর্মানুরাগী হবে। সেই বাণী মতে কৈকসীর প্রথম দুই পুত্র রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রাক্ষস হয়ে জন্মান। শেষ পুত্র বিভীষণ রাক্ষস হলেও ধর্মানুরাগী হন। এই হল এঁদের জন্মবৃত্তান্ত।


ধর্মপথচারী:


রাক্ষসপক্ষের তিনিই একমাত্র ধর্ম পরায়ণ ও সত্যের পুজারী। অনেকে বলেন 'রামায়ণ’ গ্রন্থখানির প্রধান খলনায়ক চরিত্র রাবণের ‘অপদার্থ’ ভাই বিভীষণ। বিভীষণ সম্পর্কে এও প্রবাদ আছে "ঘর শত্রু বিভীষণ"- এখন আমাদের বিচার্য বিষয় বিভীষণ কি শুধুমাত্র ঘর শত্রু ছিলেন? যে মানুষটার জন্মই হচ্ছে ধর্ম পথে হাঁটার জন্য বাস্তব জীবনে এ অন্যথা হওয়ার কথা নয়। বিভীষণের ধর্মপথচারী হওয়াটা পূর্বেই স্থির ছিল। রাক্ষস হলেও তার মধ্যে পাপাচারকে আসকারা দেওয়ার প্রবণতা ছিল না সে কারণেই সে আপন ভাই বারণের সংসর্গ ছেড়ে রামের পক্ষ নিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন রাম রাজ্য জয় করার জন্য সুদূর লঙ্কায় আসেননি। সে তাঁর ধর্মপত্নীকে রক্ষা করতে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এত দূরে এসেছেন। বিভীষণ ধর্মপরায়ণ, নির্লোভ, বিশ্বস্ত, বিষ্ণুভক্ত একজন মানুষ তাই তাঁকে ঘরশত্রু বলাটা মোটেই সমীচীন নয়, এই ধরণের ট্যাগ তাঁর চরিত্রের জন্য যথেষ্টই অমর্যাদাকর।


নিস্কাম, দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী:


রাবনের পাপকর্মে তিনি প্রথম থেকেই সাথ দেননি, বরং তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তাতে রাবন তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে তাঁকে পদাঘাত করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি এসে রামের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। রামের পদসেবা করেছেন এবং আমৃত্যু এই লড়াই এ নিজেকে রামের চরণে সঁপে দিয়েছেন। তিনি নিষ্কাম বলেই রামের পক্ষে যোগ দেয়ার পর এতটুকু দুর্বলতা নিজের স্বজাতির প্রতি দেখার নেই। এই দিক থেকে বিভীষণ চরিত্রটি ভীষণ দৃঢ়তার প্রতীক।




সততার প্রতীক:


রাবণ যখন শুক সারনকে দূত হিসেবে রামের চর পরিদর্শনের জন্য পাঠায় তখন বিভীষণ প্রথম তাদের চিনতে পারেন কারণ তিনি রাক্ষস হয়ে রাক্ষসের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তিনি নিজেই কিন্তু পারতেন শুক-সারণকে শাস্তি দিতে, তিনি তা না করে তাদেরকে নিয়ে এসেছেন রামচন্দ্রের কাছে। এভাবেই তিনি তাঁর সৎ হবার পরিচয় দিয়েছেন। বিভীষণের এরূপ সততায় সন্তুষ্ট হয়েই রামচন্দ্র সংকল্প করেছেন লঙ্কার পরবর্তী রাজা তিনি বিভীষণ কেই করবেন।




বিশ্বতার অন্য নাম বিভীষণ:


লঙ্কা কান্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে বিভীষণের বিশ্বস্ততা। রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড ভয়ংকর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে এমন অনেক পরিস্থিতি এসেছে যেখানে রামচন্দ্র বহু সমস্যা সম্মুখীন হয়েছে এবং প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। লক্ষণ তো মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করেছেন।এমন পরিস্থিতিতেও বিভীষণ কখনো ভাবিনি যে সে পালিয়ে গিয়ে আবার রাবণের পক্ষ নেবে তাতে তার প্রাণ রক্ষা হতে পারে। বরং তিনি বানরসেনারদের সঙ্গে সমানভাবে রামচন্দ্রের প্রত্যেকটা বিপদে আপদে পাশে থেকেছেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছেন এবং সেখান থেকে মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এর থেকেই আমরা বুঝতে পারি তিনি নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য রামের পক্ষ নেননি। সত্যি করেই সত্যের পথ অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন, ধর্ম পথে চলতে চেয়েছিলেন বলেই রামের পক্ষ নিয়েছেন। চিরকাল তিনি রামের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন।




পরমর্শদাতা :


শুধু বিশ্বস্ততা নয়, যুদ্ধকালে রামের পরম পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছেন বিভীষণ। বলতে গেলে বিভীষণের পরামর্শ ছাড়া রাবণের পক্ষের কোন বীরকেই রাম লক্ষণ এর পক্ষে বধ করা সম্ভব ছিল না। বিভীষন যেহেতু রাক্ষস বংশজাত লঙ্কার প্রত্যেকটি অলিগলি, প্রত্যেকটি রাক্ষস সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সেই কারণেই তিনি রামকে সর্বদা সুপরামর্শ দান করেছেন। বিভীষণের প্রত্যেকটা পরামর্শ রামের জন্য বিশেষ হাতিয়ার রূপে প্রতিফলিত হয়েছে। রাবণের ক্ষমতা কতদূর? সে কি কি করতে পারে? কতখানি তার পরাক্রম? এইসব বিষয়ে সর্বদা বিভীষণ রামকে সচেতন করেছেন তাই বারবার বিপদের সম্মুখীন হয়েও রামচন্দ্র শেষরক্ষা হয়েছে। ভস্মাক্ষ যখন যুদ্ধে আসেন তখন তিনি রামকে সচেতন করেছেন যে ভস্মাক্ষ যার দিকে চাইবে সে কিন্তু নিমিষে ভস্ম হয়ে যাবে। বিভীষণ তাকে হত্যা করার মন্ত্রণাও রামচন্দ্রকে দিয়েছেন।


জ্ঞানী ও বিচক্ষণ: 


বিশ্বস্ত, ধর্মালম্বী, নির্লোভ, নিস্কাম হওয়া ছাড়াও বিভীষণের অন্য একটি গুন হল তিনি পরম জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যাক্তি। ছিলেন সেই কারণে রামচন্দ্র তাঁকে আলাদা করে সম্মান করতেন। তার রাজনৈতিক জ্ঞান যুদ্ধ সম্পর্কে বিচক্ষণতা রামচন্দ্রকেও প্রভাবিত করেছিল। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ইন্দ্রজিৎ, রাম লক্ষণ সহ সকলে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল শুধুমাত্র হনুমান ও ব্রহ্মার বরে বিভীষণ সুস্থ ছিলেন। তিনি কিন্তু সেই সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, হনুমানকে দিয়ে পর্বত থেকে ঔষধ এনে প্রত্যেকের জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন।বিপদকালীন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি পরিচায়ক।


প্রভুভক্ত :


রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে বিভীষণের প্রভুভক্তি জ্বলন্ত উদাহরণস্বরূপ। বিভীষণের এই প্রভুভুক্তির পরিচয় আমরা পায় 'তরণীসেনবধ' কাণ্ডে। তরণীসেন যখন রাম লক্ষণের সঙ্গে যুদ্ধে আসে সে সংবাদ বিভীষণ নিজেই রামের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাম তাঁকে তরণীসেনকে হত্যা করতে বললে তিনি জানান প্রভু যেন নিজের হাতেই তরুণী সেনকে বধ করেন। ব্রহ্মার বর আছে তরণী সেনের ওপর তাই ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়া অন্য কোন অস্ত্রে তার মৃত্যু সম্ভব নয়। রাম সেই মতোই কাজ করে‌, ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েই তরণীসেনকে বধ করেন। বিভীষণ পিতা হয়ে স্বচক্ষে নিজের প্রভুর হাতে সন্তানের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। এর থেকে বড় প্রভু ভক্তির পরিচয় বোহয় আর কোথাও মিলবে না। এইখানটা খুব সুন্দর করে কৃত্তিবাস বর্ণনা করেছেন।


হাহাকার শব্দে ভূমে পড়ে বিভীষণ।।


অঙ্গের দুকূল ভাসে নয়ণের জলে


ধেয়ে গিয়ে বিভীষণে রাম কৈলা কোলে।।


এই কারণেই রামায়ণ কালজয়ী মহাকাব্য। একেই বলে সার্থক যুদ্ধ। যে ধর্মযুদ্ধে পিতা পুত্রের মৃত্যুকেও যোদ্ধার মতো মনে নিচ্ছেন এবং মৃত্যুর পর পিতা হিসেবে তার জন্য চোখে জল ফেলছেন। কৃত্তিবাসের লঙ্কাকাণ্ডের প্রতিটি ছত্রের বিভীষণের চরিত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এমন মহান চরিত্র সত্যিই সৃষ্টি সত্যিই প্রশংসনীয়।


কিন্তু মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ'কে যদি আমরা সামনে রাখি তাহলে আমাদের একটা প্রশ্ন তুলতেই হয়। বিভীষণ যদি রাবণের জায়গায় থাকতেন তাহলে কি তিনি এতটা মহানুভবতা দেখাতে পারতেন? কারণ শাসকের বিপরীত দিকে থেকে যে কাজগুলো তিনি করতে পেরেছিলেন শাসকের আসনে থাকলে তিনি কি সেই একই কাজগুলো করতে

 পারতেন? নাকি তিনিও রাবনের মতো করেই ভাবতেন?








Comments